মহীনের ঘোড়াগুলি - পরিচয়




১৯৭৯ সালে রবীন্দ্র সদনের কনসার্টে মহীনের ঘোড়াগুলি। বাঁ দিক থেকে: রাজা বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রদীপ চট্টোপাধ্যায় (বুলা),
তাপস দাস (বাপি), প্রণব দাসগুপ্ত, গৌতম চট্টোপাধ্যায় ও রঞ্জন ঘোষাল।


এক সান্দ্র অন্ধকার থেকে একে একে বের হয়ে আসা ঘোড়ার দল সব। কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তর থেকে একেবারে উঠে পড়া শহরের নাগরিক ধাঁচে। খুরের আওয়াজ, হ্রেষাধ্বনি, আর তার সাথে সঙ্গত করে চলা অগুণতি বাদ্যযন্ত্র, এই তো আমাদের মহীনের ঘোড়াগুলি। যাদের আগে আর কিছু নেই, শূন্য। আর পরে? অনন্ত আকাশ।


ষাটের দশকের শেষে গৌতম চট্টোপাধ্যায় পার্ক স্ট্রিটে The Urge বলে একটি ব্যান্ডে গিটার বাজাতেন, সাথে পড়তেন প্রেসিডেন্সিতে। তারপর এলো বিপ্লব, আগুনের দিন। নকশালবাড়ির সেই উত্তাল সময়ে পুরোদস্তুর রাজনীতিতে জড়িয়ে গৌতম তখন আন্ডারগ্রাউন্ডে। ভাই প্রদীপ, শিবপুর বিই কলেজের ছাত্র বুলাকে, একদিন ক্যাম্পাস থেকে তুলে নিয়ে গেল পুলিশ। মায়ের অসুস্থতা জানতে পেরে ফিরেছিলেন গৌতম একদিন। সেই রাতে তিনিও গ্রেফতার হন। এরপর মার, অত্যাচার। প্রতিরাতে দেহটাকে সেলের খুপরিতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে যাওয়া। আর স্বপ্নভঙ্গ, একটু একটু করে। জেলেই কি তবে গড়ে উঠেছিল "কথা দিয়া বন্ধু ফিরা না আইলা" গানের ভিত? কী জানি।

আরও দেড় বছর পরে, জেল থেকে বেরিয়ে গৌতম গিটারসহ জবলপুর, কোনও এক ওষুধের কোম্পানির রিপ্রেজেন্টেটিভ। ধুর! চলে এলেন কলকাতা সেই চুয়াত্তরে। আর পঁচাত্তরে দুইভাই বুলা, বিশু, তুতোভাই রঞ্জন, বিশুর বন্ধু আব্রাহাম, বাপি আর তপেশ- মহীনের ঘোড়াগুলির হ্রেষাধ্বনি প্রথম শোনা গেল। ১৯৭৫ সালের কোনও এক মেরুন সন্ধ্যালোকে সাত জন যুবক যে গানের দল তৈরি করেন, কীভাবে তা ঢুকে গেল ইতিহাসে এ কথা স্বয়ং আজ ইতিহাস। দীপক মজুমদার লিখেছিলেন "শহরটা ধীরে ধীরে বাবু ও বেশ্যাদের দখলে চলে গেছে" ঠিক সেইখানে দাঁড়িয়ে মহীনের ঘোড়াগুলি মেলল তাঁদের পাখা, 'শূণ্য ডানায় বায়ু বীত গতিবেগ'...



এরপর সাত বছর, গোটা পনেরো অনুষ্ঠান, বান্ধবীদের গয়না বিক্রি করে বের করা তিনটে রেকর্ড, রেকর্ড হওয়া আটটা আর না-রেকর্ড হওয়া কয়েকটা গান। ১৯৮১ তে ভেঙে যাওয়া দল... মহীনের ঘোড়াগুলি তখন 'জেব্রার পার্শ্বে চরিতেছে'। বাংলা গান শুনে তখন বধিরতার দিকে এগোচ্ছেন মননশীল শ্রোতা। সেখানে মহীন থার্টি পিস অর্কেস্ট্রা নিয়ে গাইছে 'অজানা উড়ন্ত বস্তু'র গান, গাইছে 'মেরুন সন্ধ্যালোক'.... পেটরোগা বাঙালি নিতে পারে?

কবীর সুমন একবার বলেছিলেন, প্রত্যেকটি শহরেরই একটা মিউজিকস্কেপ থাকে। মহীনের ঘোড়াগুলির কৃতিত্ব এখানেই, তাঁরা নিজেরাই বানিয়েছেন নিজেদের মিউজিকস্কেপ। পরবর্তিকালে যা আলোকবর্তিকা হয়ে আছে পরের প্রজন্মের গানের দলগুলোর কাছে, আর থাকবেও চিরকাল।



মহীনের ঘোড়াগুলি

গৌতম চট্টোপাধ্যায় (মাণিক) - কন্ঠ, কথা, লিড গিটার, স্যাক্সোফোন
প্রদীপ চট্টোপাধ্যায় (বুলা)- কন্ঠ, বেস গিটার
তাপস দাস (বাপি)- কন্ঠ, কথা, গিটার
রঞ্জন ঘোষাল- কথা, মিডিয়া রিলেশান, সংযোজক
আব্রাহাম মজুমদার- পিয়ানো, ভায়োলিন, ভায়োলা
বিশ্বনাথ চট্টোপাধ্যায় (বিশু)- ড্রামস, বেস ভায়োলিন, গিটার 
তপেশ বন্দ্যোপাধ্যায় (ভানু)- কন্ঠ, গিটার (১৯৭৫-৭৮)

রাজা বন্দ্যোপাধ্যায়- গিটার (১৯৭৮-৮১)
প্রণব সেনগুপ্ত- ড্রামস
তপন চট্টোপাধ্যায়
প্রবাল হালদার
শর্মিষ্ঠা চট্টোপাধ্যায়
সঙ্গীতা ঘোষাল



একটি অনুষ্ঠানে বিশ্বনাথ, গৌতম, তাপস ও পিয়ানোতে আব্রাহাম

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন